
প্রায় সময় আমি একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হই। যেখানে আমাকে আমার পরিচয় তুলে ধরতে বলা হয়। যদিও আমি বেশ কয়েকবার আমার লেখা পড়া থেকে শুরু করে জন্ম এবং বেড়ে উঠা নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছি, এরপরেও অনেকে আমার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন বলে আজ কিছু কথা লিখলাম। সময় থাকলে লেখাটি পড়বেন এবং আমার লেখার কোনে জায়গায় কোন কিছু আপনার পছন্দ না হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। খেয়াল করবেন আমি শুধুমাত্র আমার সরাসরি পূর্বপুরুষদের কথা বলতে যাচ্ছি এবং এখানে আমার প্রসারিত পরিবার সম্পর্কে কিছুই বলছি না।
পরম করুণাময় আল্লাহ্ পাকের নামে আমি লেখা শুরু করতে যাচ্ছি।
আমার নাম ফারাজ করিম চৌধুরী । জন্ম ২৬ আগস্ট ১৯৯২। ঢাকার স্কলাস্টিকা থেকে স্কুল জীবন শেষ করে বিশ্বের নাম করা এক বিশ্ববিদ্যালয় কিংস কলেজ লন্ডন হতে বি.এ. পলিটিক্স ডিগ্রী লাভ করি। পরবর্তীতে দি ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টার থেকে এম.এ. পলিটিকাল সাইন্স ডিগ্রী লাভ করি। রাজনৈতিক প্লাটফর্মে ‘গুজব’ শব্দটি অতিব্যবহৃত যে কারণে আমারো তা পছন্দ নয়। তারপরেও বলতে হয় যে অনেক ওয়েবসাইটে দেখি যে আমাকে বিবাহিত বলা হয়ে থাকে যা একটি গুজব। আমি অবিবাহিত।
জীবনে প্রথম মঞ্চে উঠে বক্তব্য দিই ২০০৪ সালে আরব আমিরাতে। বয়স তখন ১২ বছর। তখন শুধু বলতে পেরেছিলাম এতটুকুই যে আমার বাবা পিতা হিসেবে ভালো তবে নেতা হিসেবে কেমন তা আপনারা জানেন। ২০১২ সালে এসে উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত হই এবং সদস্য পদ লাভ করি। তবে স্বপ্ন ছিল একজন সমাজ কর্মী হিসেবে কাজ করার। তাই গত বছর একটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সমাজের কাজে নেমে পড়ি। বর্তমানে আমি আমার পরিবারের কিছু ব্যবসা দেখাশুনা করি এবং সেই সাথে সমাজের জন্য ছোটখাটো কাজ করার চেষ্টা করি।
মুরুব্বীদের মুখ থেকে শুনেছি যে আমার পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন গৌড় রাজ্য থেকে। পূর্বপুরুষদের মধ্যে প্রথম এই অঞ্চলে আসেন শেখ মুহাম্মদ বারাদাম লস্কর। কেউ কেউ বলেন আমাদের পরিবার এই অঞ্চলে আসেন পার্সিয়া হতে। পার্সিয়া অর্থাৎ এখন যেই দেশকে আমরা ইরান বলে চিনি। প্রমান চাইলে হাসি ঠাট্টা করে আমার পিতার এবং চাচাদের চেহারার দিকে দেখতে বলে আমাদের মুরুব্বীরা। আমি সবসময় প্রমাণে বিশ্বাসী যা আমার স্বভাব। যেহেতু তারা দেখতে কিছুটা ভিন্ন এই কারণে হয়তো অনেকে তা ভেবে থাকেন। যাহোক আমার পূর্বপুরুষদের অনেকের নামের শেষে মুই শব্দটি ছিল যার অর্থ হচ্ছে মুকিম। পার্সিয়ান ভাষায় মুকিমের অর্থ হচ্ছে জায়গীরদার। জমিদার আর জায়গীরদারের মধ্যে পার্থক্য আছে। জায়গীর অথবা জগীর বা জাগের ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামী শাসনব্যবস্থার সময় গড়ে ওঠে। যা শুরু হয় ১৩ তম শতাব্দীর শুরুতে। যার মধ্যে একটি রাষ্ট্র কর্তৃক কর কর্তন ও কর আদায় করার ক্ষমতা রাষ্ট্র দ্বারা একজন নিযুক্ত ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছিল। প্রজাদের জায়গীদারদের অধীন বলে গণ্য করা হতো। এই বংশ হতে আসেন আমার দাদার দাদার দাদার বাবা শেখ আজিজুল্লাহ চৌধুরী। যার প্রতিষ্ঠা করা মসজিদ এখনো আমাদের বাড়ির প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে আছে। শেখ আজিজুল্লাহ চৌধুরীর নাতি বক্স আলী চৌধুরীর নামেই আমাদের রাউজানের পারিবারিক বাড়িটি। যা ইতোমধ্যে আপনারা অনেকেই দেখেছেন। বক্স আলী চৌধুরীর পুত্র ইকবাল আলী চৌধুরীর কবর আমাদের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে আছে। ইকবাল আলী চৌধুরীর পুত্র ছিলেন আমার বাবার দাদা খান বাহাদুর আব্দুল জব্বার চৌধুরী। খান বাহাদুর ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত একটি উপাধী। ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে সামাজিক ভালো কাজের স্বীকৃতস্বরুপ মুসলমানদেরকে এই উপাধি দেয়া হতো। হিন্দুদের জন্য একই শ্রেণীর উপাধি ছিল রায় বাহাদুর। মুসলমানদের জন্য খান বাহাদুর হতে নিম্ন পর্যায়ের উপাধি ছিলে খান সাহেব। আর হিন্দুদের জন্য রায় বাহাদুর হতে নিম্ন পর্যায়ের উপাধি ছিল রায় সাহেব। খান বাহাদুর আব্দুল জব্বার চৌধুরীর সহ ধর্মিনী ছিলেন মধ্যযুগীয় মুসলিম মহিলা কবি রহিমুন্নেসার পৌত্রী বেগম ফাতেমা খাতুন চৌধুরানী। যদিও প্রথা অনুযায়ী কবি আমার সরাসরি বংশধর নয়, তারপরও তার বংশের পরিচয় আমার তুলে ধরা উচিত বলে মনে করি। কারবালা যুদ্ধের পর কবি রহিমুন্নিসার আদি পুরুষ বাগদাদ হতে এসে বিহারের মুঙ্গেরে বসতি স্থাপন করেন। পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পর বাংলার বুক যখন ইংরেজদের করাল চাবুকে জর্জরিত, তখন নবাব মীর কাশিম তার রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স্থানান্তর করেন। নবাব মীর কাশিমের সাথে ইংরেজদের পর পর কয়েকটা যুদ্ধ হয়। যা ঘেরিয়া, কাটোয়া, উদয়নালা-বক্সার নামে পরিচিত। নবাব মীর কাশিম পরাজিত হয়ে পালিয়ে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। নবাবের পরাজয়ের পর ইংরেজদের হাতে যখন মুঙ্গের বাসী মুসলিমরা অত্যাচারিত হয়েছিল তখন কবি রহিমুন্নিসার বংশধরেরা মুঙ্গের হতে চট্টগ্রামে আগমন করেন। কবি রহিমুন্নিসার পিতামহ জংলী শাহ ইসলামাবাদ খ্যাত চট্টগ্রামে আগমন করেন এবং শুলক বহরে বসতি স্থাপন করেন। জঙ্গী শাহ নাম ধারণ করে পীর হিসেবে অসংখ্য লোককে মুরিদ করে দ্বীনের পথে এনে নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করে চট্টগ্রামে বিখ্যাত হন। কবির জন্ম চট্টগ্রামের শুলক বহরে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে।
এবার আসি খান বাহাদুর আব্দুল জব্বার চৌধুরীর বড় পুত্র আমার দাদা এ.কে.এম. ফজলুল কবির চৌধুরীর কথায়। তিনি সাবেক পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা (লিডার অফ দা অপজিশন), পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম পোর্ট-ট্রাষ্টের ভাইস চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট, মেরিন এন্ড মার্কেন্টাইল একাডেমীর গভর্ণর ও চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক কাউন্সিলের কাউন্সিলর ছিলেন। এছাড়া তিনি রাউজান গহিরা শান্তির দ্বীপের ও রাউজান কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম নাইট কলেজ, চট্টগ্রাম মহিলা কলেজ এবং চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। জনাব চৌধুরী একক প্রচেষ্টায় ১৯৬৩ সালে রাউজান কলেজ এবং ১৯৬২ সালে রাউজানের গহিরায় শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জনকারী বেলজিয়ামের ফাদার পীয়ের অনুদানে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তির দ্বীপ। তিনি ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইনশাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
সংসদে বেশিরভাগ বক্তব্য তিনি ইংরেজিতে দিতেন। এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলতেন, আমার দেশের প্রতি অবিচারের কথা আমি বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই। সেই অর্থেই আমার বক্তব্যগুলি আমি ইংরেজিতে তুলে ধরি। খেয়াল করে দেখবেন ৬০ এর দশকের রাজনীতিবিদদের স্বভাব, প্রকৃতি এবং কোয়ালিটি অন্য ধরণের ছিল। ইংরেজি এবং বাংলা দুই ভাষায় তারা দক্ষ ছিল। ১৯৬৩ সালের ২৫ জুন হতে ৩ জুলাই পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের সভায় তিনি সংসদে পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য নিয়ে ফ্যাক্টস এন্ড ফিগারস সহ জোরালো বক্তব্য দেন। যার প্রমাণ বিখ্যাত লেখক স্টিভেন আই উইলকিনসনের ‘আর্মি এন্ড নেশনস’ বইতে রয়েছে। ১৯ জুন ১৯৬৪ সালে তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যদি কোন ষড়যন্ত্র করা হয় তবে তিনি চট্টগ্রামের অন্যান্য সংসদ সদস্যদের নিয়ে পদত্যাগ করবেন।
আমার পিতা-মাতার পরিচয় নিয়ে। পিতা এ.বি.এম.ফজলে করিম চৌধুরী ১৯৯৬ সাল থেকে বর্তমান অবধি তার রাজনৈতিক জীবনধারা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে টানা ছয় বার [১৯৯৬, ২০০১, (২০০৬ সালে নির্বাচন স্থগিত), ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮] মনোনয়ন পেয়ে চট্টগ্রাম-৬ রাউজান আসনে টানা চার বার (২০০১, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮) সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর এ.বি.এম. ফজলে করিম চৌধুরী গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও ২০১৪ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে তিনি পুনরায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন।
আমার মা ব্যারিস্টার রিজওয়ানা ইউসুফের দাদার নাম জনাব কে. আর খাদেম। তিনি ব্রিটিশ শাসন আমলে পুরো ঢাকার এসডিও ছিলেন। তার পুত্র আমার নানা ব্যারিস্টার এ. আর. ইউসুফ। এরশাদ আমলে জাতীয় পার্টি হওয়ার পূর্বে প্রথমে মন্ত্রী এবং তারপর রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা ছিলেন। ছাত্র জীবনে তিনি প্রথমে এ.টি.এম. তাহা ও ফরমানুল্লাহ খান সহ ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্ট প্রতিষ্টা করেন।
আমার নিজের এবং পরিবারের পরিচয় সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরতে আমি চেষ্টা করেছি। আমার কথায় কোন ভুলত্রুটি থাকলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সকল প্রশংসা আল্লাহ্র, আজকের মতো বিদায় নিলাম। আল্লাহ্ হাফেজ।