ভেবেছিলাম খুলবোনা খামটা। কোনদিনও না।
ভেবেছিলাম খুলবোনা খামটা। কোনদিনও না।
অনাদিকালের জন্য ফেলেও রেখেছিলাম
পুরনো পত্রপত্রিকা, বই, ঈদসংখ্যা এরকম না-পড়া
বিদ্যার স্তুপের মধ্যে। তাছাড়া এতদিনে ভুলেও
গিয়েছিলাম খামটার কথা । সরকারি চাকুরি । আমি যতবার
নড়াচড়া করেছি, বাকি সব গাট্টিগুট্টার সাথে বইয়ের
কার্টনগুলাও স্থানবদল করেছে। স্ত্রীর ঝাঁটার
বাড়ি থেকে হা-হা করে ছুটে এসে রক্ষা না
করলে কবেই এগুলো সমাধি লাভ করতো।
প্রতিবারই হাত জোড় করে বউকে বলেছি, প্লিজ,
আর ক’টা দিন সময় দাও, একটু সময় বের করে নিই,
তারপর এক বৈঠকেই পুরো স্টক গিলে
ফেলবো।
মুখ ঝামটা দিয়ে বউ তখন বলেছে, ইঁদুরের সময়
হবে, উইপোকার সময় হবে, কিন্তু তোমার
কোনদিন সময় হবে না।
ব্যাপারটা আসলেই তাই। উইপোকা আমার বিদ্যার
ভাণ্ডারে হাত দিয়েছে তা আজকে নিজচোখে
না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। আমি যতবড়
দায়িত্বপূর্ণ কর্মকর্তাই হই না কেন আর কাজের
চাপ যতই থাকুক না কেন বউ ওসবের ধার ধারে না।
সে আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছে, আগামি ঈদের
আগে আগে ঘর ঝাড়ামোছা অভিযানে আমার
বিদ্যার জাহাজকে জলে ভাসিয়ে দেয়া হবে।
অতএব, ঈদ আসার আগেই আমার যা করণীয় তা
করে ফেলতে হবে।
তাই, পড়ি কিম্বা না পড়ি, মোহগ্রস্থ হয়ে এতদিন যে
সম্পদ ধরে রেখেছি তার সুরক্ষার ব্রত নিয়ে
আজকেই উইপোকার বিরুদ্ধে নেমে পড়েছি।
গ্রাম থেকে নিয়ে আসা আজগর ছেলেটা
ষ্টোররুমের সিলিংঘেষা তাকের সব কাগজপত্র
নামিয়ে ঝেড়েমুছে বইপুস্তকগুলোকে
কার্টনবন্দি করছিল। তখনি হঠাৎ কুড়িবছর আগের
সেই খামটি চোখে পড়লো। ঝকঝকে
অক্ষরে ঠিকানা-লেখা ডাক বিভাগের ঈষৎ হলুদ
রঙের লেফাফাটি এসেছিল পিএটিসিতে – আমার
ফাউণ্ডেশন ট্রেনিং চলছিল তখন। আমি খুলিনি । আমার
উষ্মার স্মারক হিসেবেই এটাকে আঠাবদ্ধ অবস্থায়
রেখে দিয়েছিলাম।
আজ কী জানি হয়ে গেল। স্থানান্তরের জন্য
কার্টনস্থ বইপুস্তকের সাথে খামটা না রেখে ওটা
নিয়ে এলাম ফতুয়ার পকেটে করে। আজ ছুটির
দিন। খাওয়াদাওয়া সেরে বউ নাক ডাকিয়ে ঘুমাবে।
সেই ফাঁকে বারান্দায় বসে একটা সিগ্রেট টানতে
টানতে খামটা খোলার প্ররোচনা দিচ্ছে আমার
বিচলিত মন। বুঝতে পারছি, আমি কাঠিন্য হারাচ্ছি।
শেষপর্যন্ত অস্থির কৌতুহলই জয়ী হলো।
বারান্দার দোলচেয়ারে বসে সিগ্রেটের
ধোঁয়ার রিং তৈরি করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে
ভাবছি, যে রেখা আমাকে ল্যাং মেরে রামধনুর
সাতরঙা সেতু পার হয়ে রঙিন জগতে পাড়ি জমালো
তার এই অর্থহীন পত্রের প্রতি আমার
কিশোরসুলভ ঔৎসুক্য হাস্যকরই বটে। এ ভাবনা
মাথায় চক্কর খেলে কী হবে, আমার হাতদু’টি
ঠিকই খাম থেকে চারপৃষ্ঠার চিঠিখানি অবমুক্ত করে
ফেললো।
প্রিয়তমেষু,
ভালবাসার দাবি নিয়ে অনুরোধ করছি, আমার চিঠিখানি
পড়ো’। তারপর তোমার যা-ইচ্ছা তাই বলো।
কাল আমার ফ্লাইট। উড়োজাহাজ আকাশে উড়বার
সাথে সাথে এ মাটির সাথে আমার সম্পর্ক চিরদিনের
জন্য ছিন্ন হয়ে যাবে। আমি অন্য এক
আলোঝলমল মানচিত্রের প্রসাধনীর আড়ালে
নিজেকে হারিয়ে ফেলবো।
মনসুর অর্থাৎ আমার স্বামী ম্যানচেষ্টারে নতুন
বাড়ি কিনেছে। মৃত্যু অব্দি ওটাই আমার ঠিকানা।
প্রিয়তম, ভাবছো কি অবলীলায় আমি নিষ্টুর
কথাগুলো বলে ফেললাম! এতে কি আমার
রক্তক্ষরণ হচ্ছে না? কিন্তু আমাকে যে বলতে
হবে।
আমার বাবা-মা’র পরিচয় তোমার অজানা ছিলনা। বিশাল
বিত্তশালী পরিবারের একমাত্র মেয়ে আমি –
একমাত্র সন্তানও। আমি ভাল করে জানি, তুমি
বিত্তের লোভে আমাকে ভালবাসোনি। আমিও
বিত্তকে ভালবাসার মাঝখানে এনে দাঁড় করাইনি।
আমার ব্যবসায়ী বাবা পৃথিবী চষে
বেড়িয়েছেন। মাকে নিয়ে আমিও বাবার সাথে
ঘুরেছি অনেক দেশ। দেশ-বিদেশে অনেক
বন্ধু বাবার। লণ্ডনে গেলে মনসুরদের হাইবারি
হিলের বাড়িতে যেতেই হতো। আমিও গিয়েছি
একবার। মনসুরের মা সাদা বৃটিশ মহিলা হলেও বাঙালি
আচার-আচরণ রপ্ত করে ফেলেছিলেন। সিলেটি
অ্যাকসেন্টে কথা বলতে পারেন। আমাকে
অনেক আদর করেছেন তিনি। বাংলাদেশের
অনেক স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। মনসুর-মরিয়ম
অনেক গল্প করেছে। কক্সবাজার সী-বীচ,
মেঘনার রিভার ক্রুজ, সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট
ওদের ভালই মনে রয়েছে। ছোট থাকাকালে
ওরা দু’বার বাংলাদেশে বেড়িয়ে গেছে।
সিলেটে দাদার বাড়িতে গেলেও তারা বেশি সময়
থেকেছে আমাদের গুলশানের বাড়িতে।
ছোটবেলার এসব স্মৃতি কিছুটা মনে আর কিছুটা
আছে পুরনো অ্যালবামে। তবে তোমার আমার
সম্পর্কের মধ্যে এসব ঘটনা বা স্মৃতির যোগসূত্র
নেই; তাই কখনোই তা বিশদভাবে আলোচনায়
আসেনি।
তোমার-আমার স্বপমোড়ানো দিনগুলি আমাকে
কখনো স্বস্থি দেবে না তা আমার চেয়ে তুমিই
ভাল বোঝ। বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে সবে তুমি
রৌদ্রকরোজ্বল সোপানে পা রেখেছ। আর
ঠিক সে মুহুর্তেই তোমার হাতের মুঠি থেকে
আমার হাতখানি ফসকে বেরিয়ে গেল! এ যে কত
ভয়ঙ্কর পতন; কী যে হৃদয় বিদীর্ণ করা
বজ্রপাত তা তোমার মত আমিও অনুভব করি। কিন্তু
কেন এই আকস্মিকতা, কেন এই প্রলয়; এ প্রশ্ন
তোমার থাকতেই পারে।
আমার কষ্ট হয়েছে। খুবই কষ্ট হয়েছে
নিজেকে দুমড়েমুছড়ে ভেঙ্গে ফেলতে।
হোক। তবু তুমি এরকমের কষ্ট পাওয়ার কোন
ঝুঁকি নাও তা আমি চাইনি। তাছাড়া এ চিঠি পড়ার পর তোমার
নিজেরই মনে হতে পারে আমার অন্তর্ধান
তোমার-আমার জন্য ছিল একটা মঙ্গলজনক সিদ্ধান্ত
।
আমার বাবা যদি এত সততা না দেখাতেন, তবে
হয়তো আজকে আমাকে এই কৈফিয়ত দিতে
হতো না; আমিও তোমার কাছ থেকে পালিয়ে
বাঁচার চেষ্টা করতাম না। আমার বিশ্বাস, মনসুরের পিতার
অকালমৃত্যুর পিছনে আমার বাবার সততা কিছুটা হলেও
দায়ী। বাবার সততা মনসুরের পরিবার মাড়িয়ে যখন
আমার সামনে এসে স্বমূর্তি নিয়ে দাঁড়ালো তখন
আমার আর দাঁড়াবার জায়গা থাকলো না। আমি কোন
এক পরজাগতিক মাধ্যাকর্ষণের টানে অচেনা
ব্ল্যাকহোলের দিক ধাবিত হতে থাকলাম।
কিন্তু এসবের পরেও মনসুরের প্রচণ্ড জেদ
আমাকে অতল গহবর থেকে টেনে তুললো।
তুললো ঠিকই, তবে তা খাদের অপর পারে। এপার
ওপারের মাঝখানের খাদটাই চিরদিনের জন্য
বিচ্ছেদরেখা হয়ে রইল।
আমার অজান্তে বাবাই বেশি করে চাইছিলেন
মনসুরের সাথে আমার বিয়েটা হোক। বাঙালি পিতার
সন্তান হলেও তার ধমনীতে ইউরোপের রক্ত
বইছে, ইউরোপের জলহাওয়া গায়ে মেখে বড়
হয়েছে সে। সে কারণে সে উদার মনের
হবে এমনি ধারণা বাবার । তাই আমার বাবা যখন বন্ধুর
কাছে কথাটা পাড়লেন মনসুরের বাবা তখন আনন্দে
আটখানা হয়ে ছোটখাটো পার্টিই দিয়ে
ফেললেন লণ্ডনে। মনসুর বিলেতি ছেলে
হয়েও বাবা